ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

গত বছর একদিন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের সঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাবে নাশতা করছিলাম। হঠাৎ খবর পেলাম অমিতাভ বচ্চন মারা গেছেন। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। উপমহাদেশের চলচ্চিত্রজগতের যে তিন-চারজনকে আমি শ্রদ্ধা করি, অমিতাভ বচ্চন তাঁদের একজন। আমার টেলিভিশন দেখার বিশেষ অবকাশ হয় না, কিন্তু কাজকর্ম ফেলে আমি অমিতাভ বচ্চনের ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ পুরোটাই উপভোগ করেছি। তা ছাড়া, তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা। এখনো তিনি সক্রিয়, তাই তাঁর মৃত্যুসংবাদে মর্মাহত হই। খাবারের টেবিল থেকে টিভিরুমে যাই খাওয়া শেষ না করেই। আমাদের চ্যানেলগুলোর স্ক্রলে কিছু দেখা গেল না। ভারতীয় চ্যানেল ঘুরিয়ে দেখি সেখানেও গানবাজনা হচ্ছে, অমিতাভ বচ্চনের কোনো খবর নেই। আমার বিচলিত ভাব দেখে সাংবাদিকদের কেউ কেউ তাঁদের অফিসে ফোন করে জানলেন এ রকম কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আমার ছেলেকে বললাম, কারও কম্পিউটার থেকে ওই সংবাদের একটা প্রিন্ট বের করে আনতে। রাতে আমি প্রিন্টের কাগজটি পড়ে দেখি, তিনি যে শুধু মারা গেছেন তা-ই নয়, তাঁর দেহ এতটাই বিকৃত হয়েছে যে তা চেনার উপায় নেই। আরও কী সব কথা। দুই দিন পরে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনো অতি দক্ষ সাংবাদিকের লেখা রিপোর্ট।
এই অপকর্মটি ২৫ বছর আগে কেউ করতে পারত না এবং করা সম্ভব ছিল না। গত দুই দশকে তথ্যপ্রযুক্তির এত অগ্রগতি হয়েছে যে মুহূর্তের মধ্যে যে কেউ যা খুশি করতে পারে এবং বিশ্বের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তের মানুষ জেনে যায়। তথ্যপ্রযুক্তির উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না, কিন্তু তার যে অপব্যবহার, বিশেষ করে বাংলাদেশে যে ধরনের অপব্যবহার হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভয়াবহ ক্ষতি হয়ে যাবে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটতে পারত না। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারে বাংলাদেশের কত সংসার ভেঙে গেছে, কত মেয়ে করেছে আত্মহত্যা।
সম্প্রচার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অপপ্রচার চালালে বা তাতে মদদ দিলে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর পাশাপাশি এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তির বিধান রেখে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬’-এর খসড়া ২২ আগস্ট মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। খসড়া আইনটির বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি অন্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না এবং অন্য আইনের সঙ্গে এটা মিলে যায় কি না, সেটি দেখার জন্য তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করেন।
কোনো রাষ্ট্রে যখন কোনো আইন জারি হয় তখন তা কোনো শ্রেণি বা গোষ্ঠীর জন্য হয় না, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যও হয় না। তা হয় সব নাগরিকের জন্য এবং অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ওই আইন প্রতিটি নাগরিক ও সরকারের লোকজনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আইনমন্ত্রী অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার কথা বলেছেন। সেটা করুন, কিন্তু আমরা যারা সাধারণ নাগরিক, তাদের অভিমত হলো, প্রথমে দেখুন আইনটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না। সরকার যে অবিলম্বে আইনটি পাস করতে বদ্ধপরিকর, তাতে কারও সন্দেহ নেই। আইনগত দিকটির বাইরেও জাতীয় ও সামাজিক জীবনে এই আইনের প্রভাব কী হবে তা বিবেচনা করা উচিত। দেশের অন্য মানুষের কথা বাদ দিলেও বর্তমান সরকার, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কতটা উপকৃত হবে, তা বিবেচনা করা প্রয়োজন।
আমি কিছুটা বিস্মিত হয়েছি আর একটি ব্যাপারে। খসড়া আইনটি অনুমোদনের পর আমাদের পত্রপত্রিকার উচিত ছিল আইনটি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা। বিচার-বিশ্লেষণ মানে বিরোধিতা নয়, ভালো-মন্দ দিক আলোচনা করা। কিন্তু তার পরিবর্তে অনেক পত্রিকা পরদিনই আইনটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে ‘যুগোপযোগী’ আখ্যা দিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছে।
আধুনিক মিডিয়ার কাছ থেকে মানুষ প্রত্যাশা করে গুরুতর বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত। সরকারের ভালো কাজে সমর্থন দেওয়া আর অন্ধ-আনুগত্য ও প্রশ্নহীন বশ্যতা এক জিনিস নয়। হয়তো ভিন্নমত সরকার সহ্য করবে না, কিন্তু সে জন্য ভিন্নমত প্রকাশ বন্ধ থাকা উচিত নয়। ১৯৭৪-এর ফেব্রুয়ারিতে যখন সরকার ‘স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট’ বা বিশেষ ক্ষমতা আইন পাস করে, তার বিরোধিতা করে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়। সরকার সমালোচনায় কান দেয়নি। পরে দেখা গেল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই ওই আইনে সবচেয়ে নির্যাতিত হয়েছেন। শুধু ওই আইন নয়, ‘ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন, ১৯৭৩’-এর বিরোধিতা করে সেকালের পত্রপত্রিকা লিখেছিল। সরকার শোনে নাই। পরে তার ক্ষতিকর প্রভাবে বিপন্ন হয়েছেন সংশ্লিষ্ট সবাই। সরকার এবং সংসদই আইন করবে, কিন্তু আইন যেহেতু নাগরিকদের জন্য সুতরাং যেকোনো আইন প্রণয়নের আগে নাগরিক সমাজের মতামত গ্রহণ অপরিহার্য।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও বঙ্গবন্ধুকে অপমান করে সে সাধ্য কার? বাংলাদেশে ইতিহাস নিয়ে যা হয় তা ‘ইতিহাস বিকৃতি’ নয়, ফাজলামি। ফাজলামির জবাব দেওয়ার জন্য আইনের প্রয়োজন নেই, জনগণই যথেষ্ট। যেমন বিএনপির লন্ডনপ্রবাসী ‘ভাইয়া’ উল্টোপাল্টা বক্তব্য দিয়ে যে অপদস্থটা হয়েছেন, তা কোনো আইন দিয়ে সম্ভব ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যদি কেউ মূর্খের মতো কিছু বলে, তাতে কিছু যায়-আসে না। তবে এই ইন্টারনেটের যুগে অনেক কিছুই ঠেকানো সম্ভব নয়।
কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার মতাদর্শ ঐশী বিধান নয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়, তাঁর জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরেও। ইতিহাসের মহানায়কদের নিয়তিই তাই। ১৯৯০ সালে আমরা দেখেছি লেনিনের মূর্তি চূর্ণবিচূর্ণ করতে। দেঙ-এর সময় মাও সে তুংয়ের অবমূল্যায়ন হয়। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যা লেখার তা হয়ে গেছে কি না। আমি বলব, না হয়নি। লেখালেখি হচ্ছে এবং তা এক অব্যাহত প্রক্রিয়া, আরও লেখা হবে। ফরাসি বিপ্লব নিয়ে গত ২০০ বছরে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জার্মানিতে অব্যাহতভাবে বই প্রকাশিত হচ্ছে। খুব বড় ঘটনা নিয়েই সাধারণত তা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা; এই ঘটনা নিয়ে ভবিষ্যতে লাখ লাখ পৃষ্ঠা লেখা হবে।
পৃথিবীর সব জাতিরই স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস আছে। বহু দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে একাধিক সংগঠন ও একাধিক নেতা ভূমিকা রেখেছেন। অনেক দেশে স্বাধীনতাসংগ্রামের বৈরী পক্ষ ছিল। বিজয়ের পরে প্রধান নেতৃত্বদানকারী সংগঠনের নেতাদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে রাষ্ট্রের সব দায়দায়িত্ব। প্রতিটি দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস বহুমাত্রিক। একটি পক্ষের একদল মানুষের লেখা একটি মাত্র ইতিহাস বইতে স্বাধীনতাসংগ্রামের সব বিষয় থাকবে, তা ভাবা যায় না। ঘটনার ভিন্ন বিশ্লেষণ মানেই ইতিহাস বিকৃতি নয়। ঘটনার কোনো তথ্য বিকৃত হলে মানুষ তা গ্রহণ করে না। কেউ যদি বলে বা লেখে একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে নাই, তা কেউ গ্রাহ্য করবে না। কিন্তু ওই দিনের ঘটনার একাধিক বিবরণ ও বিশ্লেষণ থাকা স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অমর্যাদা করার প্রবণতা কখনো কখনো হয়েছে। অতি ছোট ও অতি নষ্ট একটি গোত্র তা করেছে, কিন্তু জনগণের কাছে তা কিছুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। যারা করেছে, তাদেরই মানুষ অপমান করেছে। ভবিষ্যতেও তা-ই করবে। সুতরাং তা নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই। পাকিস্তানবাদী যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, হাজারো আইন করে তাদের মন পরিবর্তন করা যাবে না। সারা জীবন তাদের জেলে নিয়ে ঢুকিয়ে রাখলেও তারা পাকিস্তানবাদী থেকে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বর্তমান সরকারের এত উদ্বেগ, এই বুঝি কারও কথায় বা লেখায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হয়ে গেল; সেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল যে লক্ষ্যে তা হলো জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। ‘বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ’ ১৯৭২-এ যে সংবিধান রচিত হয়, তাকে সরকার ও জনগণ উভয়েই সযত্নে ‘রক্ষণ, সমর্থন ও রক্ষা’ করবেন, সেটাই প্রত্যাশিত। যে পক্ষ থেকেই—সরকারের দিক থেকে হতে পারে, নাগরিকদের দিক থেকেও হতে পারে—সংবিধানের অমর্যাদা হোক, তা অপরাধ।
রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির কী সম্পর্ক হওয়া প্রয়োজন তা সংবিধান ঠিক করে দিয়েছে। আকারের দিক থেকে রাষ্ট্র প্রকাণ্ড, ব্যক্তি ক্ষুদ্র; কিন্তু গুরুত্বের দিক থেকে ব্যক্তি ছোট নয়। সে বড় তার সাংবিধানিক অধিকারের জন্য।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রত্যেক মানুষের রাজনৈতিক ব্যাপারে কর্তৃত্ব থাকতে হবে। তারই নাম রাজনৈতিক অধিকার। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ ব্যক্তির সেই অধিকার খর্ব করতে পারে না। সেই সাংবিধানিক ও নৈতিক ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের নেই। যেসব দেশের নির্বাহী বিভাগ সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে, সেগুলো স্বৈরাচারী। ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা বা স্বাধীনতা দিতে হবে। সেই স্বাধীনতার যদি সে অপব্যবহার করে, তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি তার প্রাপ্য। কিন্তু অপরাধ না করা পর্যন্ত ব্যক্তি ভোগ করবে তার সেই স্বাধীনতা। কোনো অজুহাতেই নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা যবে না।
আলোচ্য আইনটি কার্যকর হলে বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় স্থবিরতা দেখা দেবে। তা যেমন ব্যক্তিগত পর্যায়ে হবে, তেমনি একাডেমিক পর্যায়েও হবে। সেটা জ্ঞানচর্চার পথে ঘোরতর বাধা। এবং তার দায়দায়িত্ব বর্তাবে আওয়ামী লীগের ওপর। বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য আইনপ্রণেতাদের কাছে বিনীত অনুরোধ রাখছি।

Comments

Popular posts from this blog

Fashion trends 2014 making style